ভূমিকা :
মানুষ সবসময় সমাজে বাস করে এবং সমাজের নানা নিয়ম, রীতি, আচরণ, সংস্কৃতি ইত্যাদির প্রভাব তার জীবনে পড়ে। এই সমাজকে বোঝার জন্য একটি নতুন শাস্ত্রের প্রয়োজন হয়েছিল। সেই প্রয়োজন থেকেই সমাজবিজ্ঞানের জন্ম। সমাজবিজ্ঞানী টম বটমোর (Tom Bottomore) তার Sociology গ্রন্থে বলেছেন—
"Sociology is a modern science, not much more than a century old."
অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞান একটি আধুনিক বিজ্ঞান, যার বয়স একশ বছরের বেশি নয়।
সমাজবিজ্ঞানের মূল বিষয় :
সমাজবিজ্ঞান হলো এমন একটি বিজ্ঞান যেখানে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, আচরণ, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, রীতি-নীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি বৈজ্ঞানিকভাবে অধ্যয়ন করা হয়।
প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানীদের সংজ্ঞা :
- এমিল দুর্খেইম (Emile Durkheim) বলেছেন, “সমাজবিজ্ঞান হলো সমাজতত্ত্ব বিষয়ক বিজ্ঞান।”
- ডব্লিউ. এফ. অগবার্ন (W. F. Ogburn) বলেছেন, "Sociology is a body of learning about society, therefore, defined as a science of society."
- জর্জ সিমেল (Simmel) বলেছেন, “সমাজবিজ্ঞান এমন একটি বিজ্ঞান যা মানব সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে।”
- মরিস জিন্সবার্গ (Morris Ginsberg) তার The Study of Society গ্রন্থে বলেছেন, "As the study of society, that is of the web or tissue of human inter-actions and inter-relations."
- উইলিয়াম পি. স্কট (William P. Scott) তার Dictionary of Sociology (1988:401) গ্রন্থে বলেছেন, “সমাজবিজ্ঞান হলো মানুষের সামাজিক আচরণের বৈজ্ঞানিকভাবে পাঠ ও অধ্যয়ন।”
উপরের সংজ্ঞাগুলো থেকে বোঝা যায়, সমাজবিজ্ঞান হলো সমাজ ও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, আচরণ, প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক গঠন নিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে গবেষণা করার একটি শাস্ত্র।
সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ:
মানুষের সামাজিক আচরণ নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রিত হয় দুটি শক্তি দ্বারা। এর দুটি হলো প্রাকৃতিক শক্তি এবং সামাজিক শক্তি। জীবের উৎপত্তি নির্ভর করে প্রাকৃতিক শক্তির ওপর। প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে সৃষ্টি ও বিনাশ ঘটে। অনুরূপভাবে সামাজিক জীবনের বিভিন্ন দিক মানুষের সামাজিক শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। অর্থাৎ সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্রিয়াকলাপ ও কর্মসূচি একদিকে প্রাকৃতিক শক্তি, অন্যদিকে সামাজিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল। তাই বলা যায় মানুষের সামাজিক জীবনধারার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট শক্তি কার্যকর। বর্তমান সমাজবিজ্ঞানকে একটি নির্দিষ্ট সামাজিক বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও অতীতে এরূপ ধারণা ছিল না। বর্তমান সমাজবিজ্ঞান পূর্ববর্তী সমাজচিন্তকদের চিন্তা, মতামত ও তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। সমাজবিজ্ঞান একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র এবং সমাজকে বৈজ্ঞানিকভাবে গবেষণা করার প্রয়াস আধুনিক যুগের সৃষ্টি। একথাই উল্লেখ করেছেন সমাজবিজ্ঞানী আর. এম. ম্যাকাইভার ও সি. এইচ. পেজ (R. M. MacIver and C. H. Page)। তিনি বলেছেন, "Sociology as a more or less definite body of systematic knowledge with a distinct place and name among the family of sciences must be dated by decades rather than by centuries."
প্রাচীন সভ্যতার চিন্তায় সমাজবিজ্ঞানের ধারণা বিদ্যমান ছিল, ধর্ম এবং দর্শনের মাঝে দিয়ে বিজ্ঞান উদ্ভূত হয়। তাই সমাজবিজ্ঞানও ইতিহাস যেমন ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতির সংমিশ্রণে আবির্ভূত হয়েছে। প্রাচীন কালে সকল সমাজচিন্তক সমাজ সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করলেও সমাজকে একটি স্বতন্ত্র বৈজ্ঞানিক শাস্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেননি। সমাজবিজ্ঞানকে একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসেবে প্রবর্তনের কৃতিত্ব অগুস্ত কোম্তে (Auguste Comte)-এর। তিনি ১৮৩৮ সালে ‘Sociology’ শব্দটি ব্যবহার করে সমাজবিজ্ঞানের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর একমাত্র কৃতিত্বই যে, চিন্তাকে উদ্ভাবন থেকে বাস্তব প্রয়োগে উন্নীত করেছেন। তাঁকে সমাজবিজ্ঞানের জনক বলা হয়। নিচে সংক্ষেপে সমাজবিজ্ঞানের ঐতিহাসিক বিকাশের ধারা তুলে ধরা হলো—
১. হামুরাবির সনদ ও সমাজবিজ্ঞান : বিশ্বের প্রাচীনতম কয়েক হাজার বছর পূর্বে ব্যাবিলনের হামুরাবির সনদে সমাজবিজ্ঞানের ধারা লক্ষ্য করা যায়। সনদে বিভিন্ন সামাজিক সম্পর্ক, পারিবারিক সমস্যা, অপরাধ ও শাস্তি এবং সামাজিক দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে।
২. গ্রীক সভ্যতা ও সমাজবিজ্ঞান : গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর ‘Republic’ এবং এরিস্টটলের ‘Politics’ গ্রন্থে সমাজবিজ্ঞানের ধারা পাওয়া যায়। প্লেটোর ‘Republic’ গ্রন্থে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য শিক্ষার বিশেষ গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া আইন, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে সুবিন্যস্ত আলোচনা পাওয়া যায় এরিস্টটলের ‘Ethics and Politics’ গ্রন্থে।
৩. রোমান সভ্যতা ও সমাজবিজ্ঞান : রোমান দার্শনিকদের মধ্যে Cicero-এর অবদান উল্লেখযোগ্য। তাঁর রচিত ‘De Officius (On Justice)’ গ্রন্থে নৈতিকতা, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত চিন্তা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
৪. ভারত ও চীন সভ্যতা ও সমাজবিজ্ঞান : ভারতের প্রাচীন উপনিষদ এবং অন্যত্র প্রাচীন সাহিত্যসমূহে বিভিন্ন সামাজিক তথ্যাবলী ও নিয়মকানুন বর্ণিত হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রাচীন ভারতের বৈদিক সাহিত্যসমূহ এবং কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৫. ম্যাকিয়াভেলির অবদান : ইতালির বিখ্যাত সমাজচিন্তক ও দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলি তাঁর ‘The Prince’ গ্রন্থে সমাজবিজ্ঞানের ধারণাকে বাস্তব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেন। তিনি সমাজ ও রাজনীতির গভীর সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেছেন।
৬. হেগেলের অবদান : সমাজবিজ্ঞানের বিকাশে হেগেলের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ব্যক্তিকে সমাজের সাথে একত্রে বিবেচনা করেছেন। তিনি সমাজবিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে সাদৃশ্যকরণের আলোচনা করার চেষ্টা করেছেন।
৭. ইবনে খালদুনের অবদান : অনেকের মতে ইবনে খালদুন সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো ‘The Prolegomena’ বা ‘মুকাদ্দিমা’। তিনি অগুস্ত কোম্তের পূর্বেই সমাজবিজ্ঞানের নামকরণ ও কাঠামোবদ্ধ যাত্রা শুরু করেছেন বলে সর্বজনবিদিত। এজন্য ইবনে খালদুনের অবদানকে সমাজবিজ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। করে দেখা যায় না। তিনি ‘Science of Culture’ বা ‘Al Umran’ গ্রন্থে সমাজ বিজ্ঞানের আলোচনা করেছেন। খালদুন এও বলেন, সমাজের পরিবর্তনশীলতার অনিবার্যতা রয়েছে। তিনি বলেন যে, বিশ্বের অন্যান্য জাতির মতো আরবগণও রাষ্ট্রক্ষমতার চূড়ায় উঠে অবশেষে পতনের দিকে যায়। ইবনে খালদুনের চিন্তায় প্রধান স্রষ্টি শক্তি আবেগীয়, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং ঐশ্বরিক।
৮. অগাস্ট কোমটে (August Comte) এর অবদান : ১৭৯৮ সালে ফ্রান্সে জন্মগ্রহণকারী অগাস্ট কোমটে সমাজ বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি সমাজ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি নতুন ধারণার জন্ম দেন। সমাজ বিজ্ঞানের নামকরণ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম ‘Sociology’ পরিভাষার ব্যবহার করেন। তিনি সমাজ বিজ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সমাজ বিজ্ঞানের মাধ্যমে সমাজের ঘটনাবলীকে বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব। তার মতে সমাজ বিজ্ঞানের তিনটি ধাপ রয়েছে। যথা- ধর্মতাত্ত্বিক, ভাববাদী এবং বৈজ্ঞানিক। তিনি সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখারও ভিত্তি স্থাপন করেন। যেমন- ‘Social Physics’, ‘Social Physiology’। ‘Sociology’ কে তিনি দু’টি ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন- ‘Social Statics’ এবং ‘Social Dynamics’। তিনি সমাজ বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করেন। কোমটে এর চিন্তায় প্রতিফলিত হয়েছে, সমাজ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও নিয়মিততা রয়েছে। সমাজতত্ত্ব একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ জ্ঞানের শাস্ত্র। এজন্য কোমটে কে ‘Father of Sociology’ বলা হয়। সমাজ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার অবদান অনন্য।
৯. হার্বাট স্পেন্সার এর অবদান : বিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের সমাজতত্ত্ববিদ হার্বাট স্পেন্সার সমাজ বিজ্ঞানে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবর্তন করেন। তিনি সমাজকে একটি জীবন্ত অর্গানিজম বা জীব হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি ‘Sociology’ গ্রন্থে সমাজকে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন পরিবার, রাষ্ট্র, শিক্ষা, ধর্ম, অর্থনীতি প্রভৃতি প্রাকৃতিক নিয়মে বিকশিত হয়। তিনি সমাজ বিজ্ঞানে ‘Synthetic Philosophy’ প্রবর্তন করেন। তিনি মনে করতেন সমাজ বিজ্ঞানের তিনটি অংশ রয়েছে। যেমন- i. Social Statics, ii. Principles Sociology iii. The Man versus the State.
১০. কার্ল মার্কস এর অবদান : দার্শনিক কার্ল মার্কস সমাজ বিজ্ঞানের বিকাশে বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি সমাজ বিজ্ঞানে ‘Mode of Production’ ধারণার প্রচলন করেন। তিনি শ্রেণিসংগ্রাম তথা বুর্জোয়া ও সর্বহারা শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্বকে সমাজ পরিবর্তনের প্রধান উপাদান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার চিন্তায় সমাজতাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের চিন্তাধারা প্রতিফলিত হয়েছে। মার্কস সমাজ পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্টা করেছেন।
১১. পার্সন ও মার্টন এর অবদান : বিংশ শতাব্দীতে এল. টি. Person ও Robert K. Merton সমাজবিজ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক ও এর জ্ঞানের দিগন্ত প্রসারিত করেছেন। তারা বিশ্বাস করতেন যে সমাজবিজ্ঞানের মূল দায়িত্ব হলো সমাজবিজ্ঞানের বিশেষত্ব নির্ধারণ ও এর জন্য সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্ব নির্মাণ করা।
১২. এমিল দুর্খেইম এর অবদান : সমাজ বিজ্ঞানে এমিল দুর্খেইমের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি সমাজকে একটি জীবন্ত অর্গানিজম হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। সমাজতত্ত্বের বিভিন্ন সমস্যা যেমন- আত্মহত্যা, সামাজিক পরিবর্তন, মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়ের বিশ্লেষণ করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো ‘The Division of Labour in Society’, ‘The Rules of Sociological Method’ এবং ‘Suicide’। অতএব, তিনি সমাজ বিজ্ঞানের চিন্তা বিশ্লেষণ করে সমাজতত্ত্বকে একটি সামাজিক চিন্তাধারা হিসেবে সুস্পষ্ট করেছেন।
১৩. ম্যাক্স ওয়েবার এর অবদান : সমাজ বিজ্ঞানের ইতিহাসে জার্মানির ম্যাক্স ওয়েবারের নাম গুরুত্বপূর্ণ। সমাজবিজ্ঞানের গবেষণায় আরেকটি দিক এনে দিয়েছেন তিনি। সমাজবিজ্ঞানের মানুষের আচরণ ও দুর্বলতাকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং সমাজবিজ্ঞানের পদ্ধতির মধ্যে এনেছেন। তার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Protestant Ethic and the Spirit of Capitalism’ এ। ওয়েবারের অবদান হলো, সমাজবিজ্ঞানের মূল দিকগুলো সমাজবিজ্ঞানের নন্দনতত্ত্বে উল্লেখ করা।
উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায়, বহু চিন্তকের বহু চিন্তার মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞান আজ আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে আছে। নানা ধরণের ঘটনা, পরিবেশগত সমাজবিজ্ঞান ধীরে ধীরে সমাজবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। সমাজবিজ্ঞান একটি সমৃদ্ধ শাস্ত্র হিসেবে বিকশিত হয়েছে। বিষয় হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের ব্যাপ্তি আজও চলমান। কিন্তু এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ যে, সমাজ বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু বিস্তৃত হচ্ছে। ফলে আধুনিক সমাজতত্ত্ব প্রাচীনকালের সমাজতত্ত্বের মতোই ধ্রুপদী হয়ে নতুন নতুন বিষয়বস্তু সংযোজিত হচ্ছে।
Follow Me